বার্মিজ সিগারেটে বাজার সয়লাব রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার

সোয়েব সাঈদ :


পাশবর্তী মায়ানমার থেকে চোরাইপথে আসা অবৈধ সিগারেটে সয়লাব হয়ে গেছে পর্যটন নগরী কক্সবাজার সহ দেশের প্রত্যন্ত এলাকা। নি¤œমানের এসব সিগারেট মানুষের স্বাস্থ্যহানির পাশাপাশি সরকারকে বিপুল রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করছে। ছোট-বড় মুদি, পান-সিগারেটের দোকানে আমদানি নিষিদ্ধ বার্মিজ সিগারেট প্রকাশ্যে  বিক্রি হলেও তা প্রতিরোধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোন কার্যক্রম দেখা যায় না। অথচ সরকারের রাজস্ব আয়ের অন্যতম প্রধান খাত সিগারেট। গত অর্থবছরে এখাত থেকে সরকারের আয় হয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব আয়ের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও অবৈধ সিগ্যারেট বাজার দখল করায় তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চোরাই পথে আসা বার্মিজ সিগারেট ক্রয়-বিক্রয়ের সাথে জড়িতরাই দেশে রমরমা ইয়াবা ব্যবসা অব্যাহত রেখেছে। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, চোরাই পথে সিগ্যারেটের সাথে প্রচুর ইয়াবাও আনা হয়। অনেক ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে আতাঁত করা হয় সিগ্যারেট পাচারের জন্য। কিন্তু এ সুযোগে সিগারেটের কার্টন বা বস্তায় করে নিয়ে আসা হয় ইয়াবার চালানও। যে কারণ ইয়াবা পাচার বন্ধ করতে হলে অবৈধ সিগ্যারেট পাচার বা ক্রয়-বিক্রয়ও বন্ধ করতে হবে।

গত সোমবার (২৮ জানুয়ারি) রাতে কক্সবাজারের রামু উপজেলার চৌমুহনী স্টেশনে সাদ্দাম স্টোর নামের একটি মুদি দোকানে দেখা গেছে মার্বেল, ম্যানসন, প্রিমিয়াম গোল্ড সহ আরো বিভিন্ন নামের প্রচুর বার্মিজ সিগারেট। এ বিষয়ে দোকান মালিক সাদ্দাম হোসেন জানান, এসব সিগ্যারেট আমদানি নিষিদ্ধ এবং সরকারি কর ফাঁকি দিয়ে বিক্রি হচ্ছে। এরপরও চাহিদা থাকায় ছোট দোকানীদের বিক্রির জন্য তিনি এ সিগারেট ক্রয় করেছেন।

কারা এসব সিগ্যারেট বিক্রি করে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অজ্ঞাত লোকজন এসে প্রথমে চাহিদা জানতে চান এবং কয়েকঘন্টা পর কৌশলে দোকানে সিগ্যারেট সরবরাহ করে চলে যান। এসব সিগারেট এখন সবখানেই বিক্রি হচ্ছে। তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর আপত্তি থাকলের তিনি এসব সিগারেট বিক্রি করবেন না বলেও জানান।

জানা গেছে, কক্সবাজারে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পর থেকে চোরাই পথে বার্মিজ সিগারেট পাচার বেড়ে গেছে। এমনকি কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প এবং উপজেলার প্রতিটি দোকানে প্রকাশ্যে এসব নিষিদ্ধ সিগারেট বিক্রি হচ্ছে। এখানে সিগারেটের চাহিদা ব্যাপক। অর্থাৎ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিপুল সিগ্যারেট বিক্রি হলেও সরকার কোন প্রকার রাজস্ব পাচ্ছে না।

কেবল রোহিঙ্গা ক্যাম্প নয়, কক্সবাজার সদর, টেকনাফ, উখিয়া, রামু, চকরিয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া উপজেলা এবং পাশর্^বর্তী বান্দরবান জেলায় আমদানি নিষিদ্ধ বার্মিজ সিগ্যারেট এখন সর্বত্র প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে। এসব এলাকায় প্রতিদিন ১ কোটি শলাকা সিগ্যারেট বিক্রি হচ্ছে। যার মূল্য আড়াই কোটি টাকা। এরমধ্যে সিংহভাগ রাজস্ব পাওয়ার কথা থাকলেও সরকার তা পাচ্ছে না।

সিগারেট বিক্রয়কারি কয়েকজন দোকানী জানান, এখন যে পরিমান সিগারেট বিক্রি হচ্ছে তার এক তৃতীয়াংশ কেবল বৈধ অর্থাৎ রাজস্ব প্রদান করে এমন প্রতিষ্ঠানের। বার্মিজ সিগ্যারেট প্রতিরোধ করা গেলে সরকার বিপুল রাজস্ব পাবে।
যেভাবে আসছে বার্মিজ সিগারেট ঃ বাংলাদেশে চোরাই পথে বার্মিজ সিগারেট আসা এবং ক্রয়-বিক্রির ইতিহাস পুরনো। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থাৎ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পর থেকে কক্সবাজার সহ দেশের সর্বত্র মায়ানমার থেকে চোরাই পথে অবৈধ সিগারেটে এসেছে সবচেয়ে বেশী।

সীমান্তের বিশাল এলাকা দিয়ে পাচারকারিরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে, কখনো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সহায়তায় এদেশে পাচার হয় মরণ নেশা ইয়াবা ট্যাবলেট আর নি¤œমানের সিগারেট। সীমান্তের টেকনাফ উপজেলার উপরের বাজার, জালিয়া পাড়া, শাহপরীর দ্বীপ, নাইটং পাড়া, দমদমিয়া চেক পোস্ট, খারাংখালী, ধুমধুম, বালুখালী, উনচিপ্রাং, উখিয়া উপজেলার লম্বা বিল, তুমরু, বালুখালী-২ এর পূর্বদিক, জামতলী, উলুবুনিয়া, ফালংখালীর বটতলী বাজার, থাইপালং, ভালুপালং, ভালুকিয়া, মরিচ্যার পাতাবাড়ি, বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার চাকঢালা পয়েন্ট থেকে দৈনিক ১৫-২০ লক্ষ সিগ্যারেট বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এভাবে নিশ্চিত রাজস্ব থেকে প্রতিদিন বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।

মার্বেল, জিনসিন, ম্যানসন, প্রিমিয়ার গোল্ড (প্রেমের গোল্ড), এমজি ইত্যাদি নামের নানা রকমের সিগারেট আমাদের কাস্টমস ও সীমান্ত প্রহরীর চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রবেশ করছে। এসব সিগ্যারেট থাইল্যান্ড হয়ে বার্মা সীমান্ত এবং তৎপরবর্তী বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এ দীর্ঘ যাত্রা পথে নি¤œমানের সিগারেটের গুনগত মান আরো নি¤œমুখি হয়ে পড়ে। যার ফলে নানান মরণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে এদেশের জনসাধারণ। আক্রান্তদের মধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠিও।

তারা টোব্যাকো কোম্পানীর কক্সবাজারে কর্মরত রিজিয়নাল ম্যানেজার মো. মকবুল হোসেন জানিয়েছেন, আইন-শৃঙ্খলা ও সীমান্ত রক্ষী বাহিনী, কাষ্টম্স এর নিয়মিত নজরদারি থাকলে অবৈধ ও চোরাই পথে আসা বার্মিজ সিগারেট প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। কিন্তু এ নিয়ে প্রশাসনের কোন তৎপরতা না থাকায় অবৈধ সিগারেট বিক্রি দিনদিন বাড়ছে।  

জানা গেছে, ২০১৮ সালের ২২ মে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জনস্বাস্থ্য রক্ষায় ও রাজস্ব বৃদ্ধিতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত রাজস্ব ফাঁকি দেয়া সিগারেট এবং বিদেশ থেকে অবৈধ পথে আসা চোরাচালানকৃত বিদেশী সিগ্যারেট বাণিজ্য বন্ধে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁনকে চিঠি দেন। সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াতে এ চিঠির বাস্তবায়ন জরুরী হয়ে পড়েছে।

কক্সবাজার জেলায় সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে বিপুল আমদানি নিষিদ্ধ বার্মিজ সিগ্যারেট জব্দ এবং পাচার ও বিক্রয়ে জড়িত থাকার অভিযোগ অনেক ব্যক্তিকে আটক করা হয়। আটককৃতদের মধ্যে রোহিঙ্গাও ছিলো। তথ্যমতে গত ৩ নভেম্বর কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং নয়াপাড়া বাজারে একটি মুদি দোকানে অভিযান চালিয়ে মারবেল, ম্যানসন সহ ৫৭ হাজার ৩৫০টি বার্মিজ সিগারেট জব্দ এবং রোহিঙ্গাসহ তিনজনকে আটক করে র‌্যাব-৭। এরআগে গত ১৫ অক্টোবর কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের উখিয়া থেকে ২ লাখ ৬ হাজার ৯২০ টি বার্মিজ সিগারেটসহ এক মাদক ব্যবসায়িকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-৭।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী দেশের আভ্যন্তরীন রাজস্ব আয়ের ৩০ শতাংশ আসে তামাক শিল্প থেকে। রাজস্ব আয়ের পাশাপাশি স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমানোর জন্য ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে সম্পূর্ণ তামাকমুক্ত করার লক্ষ্যে সরকার বিড়ি সিগারেটের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু অবৈধ ও চোরাই পথে আসা সিগারেট বাজার দখল করায় সরকারের এ মহৎ উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে না।